বাংলাদেশের ভূ-তাত্বিক ইতিহাস সম্পর্কে বর্ণনা (Geological Background of Bangladesh)
বাংলাদেশের ভূ-তাত্ত্বিক ইতিহাস (Geological Background)
পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর। বিজ্ঞানীরা শিলার বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে পৃথিবীর ভূতাত্বিক সময়পুঞ্জিকে কিছু যুগ ও উপযুগে বিভক্ত করেছেন। ভূ-তত্ত্ববিদরা পৃথিবীর জন্মের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ৪ টি প্রধান যুগে বিভক্ত করেছেন। যেমন-
১। প্রাক ক্যাম্বিয়ান যুগ (Precambrian era),
২। পুরাজীবীয় যুগ (Palaeozoic era),
৩। মধ্যজীবীয় যুগ (Mesozoic era) এবং
৪। নবজীবীয় যুগ (Cenozoic era)
প্রত্যেকটি যুগ এক একটি বিশেষ ঘটনা দিয়ে শুরু হয়েছে এবং যুগগুলো আবার উপযুগে বিভক্ত হয়েছে। চলুন বন্ধুরা আমরা এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই-
১। প্রাক ক্যাম্বিয়ান যুগ (Precambrian era)
প্রাক ক্যামব্রিয়ান যুগ সবচেয়ে দীর্ঘযুগ। এ যুগ পৃথিবীর মোট বয়সের ৮৫% সময় কালব্যাপী বিরাজ করেছিল। বর্তমান সময় থেকে এ যুগ প্রায় ৪৬০০ মিলিয়ন বছর থেকে ৫৭০ মিলিয়ন বছর পর্যন্ত বিরাজ করেছিল। এই যুগে যে শিলার সৃষ্টি হয়েছিল তা স্ফটিকতুল্য আগ্নেয়শিলা (Crystalline igneous) এবং রূপান্তরিত ও পাললিক শিলা ও সৃষ্টি হয়। এ সময়ে সমুদ্রে এককোষী প্রাণীর সৃষ্টি হয়। তবে এই রূপে অধিকাংশ গ্রানাইট জাতীয় শিলা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর ও দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে ১৫০ থেকে ৩০০ মিটার গভীরে গ্রানাইট প্রকৃতিক শিলা পাওয়া যায়।
২। পুরাজীবীয় যুগ (Palaeozoic era)
বর্তমান সময় থেকে প্রায় ৫৭০ থেকে ২৪৫ মিলিয়ন বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই যুগকে পুনরায় ৬ টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-
(I) ক্যামব্রিয়ান (Cambrian),
(II) অর্ডোভিসিয়ান (Ordovician),
(III) সিলুলিয়ান (Silurian),
(VI) ডাভোনিয়ান (Devonian),
(V) কার্বোনিফেরাস (Carboniferous) এবং
(VI) পার্মিয়ান (Permian)।
এই যুগকে আবার অমেরুদন্ডী প্রাণীর যুগ ও বলা হয়। এর কারণ হলো, এই সময়ে পৃথিবীতে অমেরুদন্ডী প্রাণী ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাংলাদেশে ক্যাম্বিয়ান থেকে ডাভোনিয়ান যুগে কোন শিলার সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে বঙ্গ খাতের কাঠামো গত রূপ কার্বনিফরাস যুগে ঘটেছে।
পার্মিয়ান (Permian) যুগে বৃহৎ জলাভূমি সহ নদী খাতের সৃষ্টি হয় এবং বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে উদ্ভিজ্জ ভূমির সৃষ্টি হয়। যার ফলে বর্তমানে এখানে ভূত্বকের অল্প গভীরে কয়লা পাওয়া যায়। বর্তমানে ওই অঞ্চল থেকে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উত্তোলন করা হয়।
৩। মধ্যজীবীয় যুগ (Mesozoic era)
মধ্যজীবীয় যুগ (Mesozoic era) বর্তমান সময় থেকে প্রায় ২৪৫ মিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে ৬৬ মিলিয়ন বছর পূর্ব পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই যুগকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-
(I) ট্রায়াসিক (Triassic),
(II) জুরাসিক (Jurassic)
(III) ক্রিটাসিয়াস (Cretaceous)।
মধ্যজীবীয় যুগকে আবার ডাইনোসরের যুব বলা হয়। এর কারণ হলো, এই সময়ে ডাইনোসরের আবির্ভাব ও ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ট্রায়াসিক যুগের শিলার নিদর্শন বাংলাদেশে আছে। ট্রায়াসিক অথবা ক্রিটাসিয়াস যুগের প্রথম দিকে বৃহৎ আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘটেছিল। পরবর্তীতে আগ্নেয়গিরি থেকে উৎখিপ্ত লাভা সঞ্চিত হয়ে আগ্নেয় শিলার সৃষ্টি হয়। যা বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে বিশেষ করে জামালগঞ্জ, শিবগঞ্জ প্রভৃতি জায়গায় দেখা যায়। এই শিলা কৃষ্ণ বর্ণের আগ্নেয় শিলা নামে পরিচিত।
৪। নবজীবীয় যুগ (Cenozoic era)
নবজীবীয় যুগ (Cenozoic era) প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগ থেকে শুরু হয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত চলছে।বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের জন্য নবযুগীয় যুগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ হলো এই সময়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ পাললিক স্তর অর্থাৎ দেশের অধিকাংশ ভূ-তাত্ত্বিক কাঠামো গঠিত হয়। নবজীবীয় যুগে বাংলাদেশের অধিকাংশ টেকনিক ক্রমবিকাশ হয়েছিল। নবজিবীয় যুগকে আবার স্তন্যপায়ী প্রাণীর যুব বলা হয়। নবজিবীয় যুগকে আবার দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
(I) টারশিয়ারি (Tertiary) ও
(II) কোয়ার্টানারী (Quaternary)।
চলুন এগুলো বিস্তারিত দেখে নিন।
(I) টারশিয়ারি (Tertiary)
টারশিয়ারি (Tertiary) যোগ বর্তমান সময় থেকে ৬৬ মিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে শুরু হয়ে ২ মিলিয়ন বছর পূর্ব পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। তার সেয়ারি যুগকে আবার পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা- (ক) প্যালিওসিন (Palaeocene), (খ) ইয়োসিন ((Eocene), (গ) ওলিগোসিন (Oligocene), (ঘ) মাইওসিন (Miocene), এবং (ঙ) প্লাইওসিন (Pliocene)।
টারশিয়ারি (Tertiary) যুগে মুক্তসাগর দক্ষিণ দিকে অপসারণ করে এবং সাগরের উত্তর দিকে হিমালয় পর্বতের উত্থান ঘটে। এই হিমালয় পর্বতের সৃষ্টি নদীমালা দ্বারা বাহিত পলির মাধ্যমে বর্তমান বঙ্গ খাতের কাঠামো সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ নামক এই ব-দ্বীপের পূর্ব ও দক্ষিণাংশ পর্যন্ত বেলে পাথর ও কোমলতর প্রস্তুর শিলা পরিলক্ষিত হয় যাহা টারশিয়ারি (Tertiary) যুগে সৃষ্টি হয়।
(II) কোয়ার্টানারী (Quaternary)
কোয়ার্টানারী (Quaternary) যুগকে আবার দুইটি উপভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-
(ক) প্লিস্টোসিন (Pleistocene) এই উপযুগটি বর্তমান সময় থেকে ২ মিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে শুরু হয়ে ১০,০০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
(খ) হলোসিন (Holocene) হলোসিন বা সাম্প্রতিক যুগ বর্তমান সময় থেকে ১০,০০০ বছর পূর্ব থেকে শুরু হয়ে বর্তমানে চলছে।
কোয়ার্টানারী (Quaternary) উপযুগের শুরুতে পৃথিবীর তাপমাত্রা চরমভাবে হ্রাস পায় এবং ভূপৃষ্ঠের পানি জমে বরফে পরিণত হয়। এই কারণে প্লিসটোসিন উপযুগ বরফ যুগ নামে পরিচিত। হোমোসেপিয়েন্স তথা আধুনিক মানুষের আবির্ভাব হয় এই কোয়ার্টানারী যুগে। তবে প্লিসটোসিন বরফ উপযুগে বাংলাদেশে হিমবাহজাত সঞ্চয়ের কোন তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তবে হিমালয়ের জমাকৃত বরফ গলনের ফলে সৃষ্ট পানি বঙ্গ খাতের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। তবে ওই সময়ে বঙ্গ খাত পলি অবক্ষেপনের ভূমি হিসেবে কাজ করতো। প্রকৃতপক্ষে হলোসিন উপযুগের পলিজ ও প্লিস্টোসিন উপযুগের নদীজ সঞ্চয় বাংলাদেশের ৪ ভাগের ৩ ভাগ ভূমি গঠিত হয়েছে। এখনো পর্যন্ত এই গঠন কার্য সমাপ্ত হয়নি। বাংলাদেশের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকায় প্লাবনভূমিতে গঠন কার্য চলছে।
মন্তব্য
বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। আমি আশা করছি এই বিষয়ে আপনাকে পরিপূর্ণ তথ্য দিতে সক্ষম হয়েছি। এই বিষয়ে যদি আপনার কোন মন্তব্য থেকে থাকে তবে আমার কমেন্ট বক্সে জানিয়ে রাখবেন। আমি প্রতিটা কমেন্টসের গুরুত্ব সহকারে উত্তর দিয়ে থাকি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url