বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জলনিষ্কাশন সমস্যা ও নদীব্যবস্থা সমূহ

ভূমিকা

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। এই দেশে নদীর শাখা, প্রশাখাসহ প্রায় ৭০০ নদী আছে, এগুলোর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪,১৪০ কিলোমিটার। দেশের অধিকাংশ ভূমি নদীবাহিত বলি দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদী। ব্রহ্মপুত্র নদও এক সময় দেশের প্রবাহমান নদী ছিল। ধলেশ্বরী, কর্ণফুলী বেশ বড় নদী। পাশাপাশি বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, গোমতী, তিস্তা, আত্রাই, করতোয়া, আড়িয়াল খাঁ, ইছামতি, মহানন্দা প্রভৃতি নদী দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা ও প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর প্রভাব বিস্তার করে।

বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থা (River system of Bangladesh)

বাংলাদেশের সর্বত্র নদী জালের মত বিস্তার করে রয়েছে। সাধারণত দেশের প্রায় সব নদী দক্ষিণমুখী, এর কারণ হিসেবে বলা যায়, ভূমির ঢাল উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে ক্রমশঃ ঢালু। বাংলাদেশের নদীর ব্যবস্থাকে প্রধানত ৫ ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায় যথা-

১। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় নদী ব্যবস্থা (Northwest Region River System)
২। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বা গাঙ্গেয় নদী ব্যবস্থা (Southwest Region River System)
৩। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী ব্যবস্থা (Brahmaputra-Jamun River System)
৪। সুরমা-মেঘনা নদী ব্যবস্থা (Surma-Meghna River System)
৫। পাহাড়ী নদী ব্যবস্থা (Hillstax River System)

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জলনিষ্কাশন সমস্যা ও নদীব্যবস্থা সমূহ

২। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বা গাঙ্গেয় নদী ব্যবস্থা (Southwest Region River System)

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ খুলনা ও বরিশাল বিভাগ গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকার অন্তর্গত। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব-দ্বীপ। অতীতে কোন এক সময় এই অঞ্চলটি বঙ্গোপসাগরের অংশ ছিল, কালক্রমে গঙ্গার বাহিত পলি সঞ্চিত হয়ে ভূমি গঠন করে যা, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল। এই নবগঠিত ভূমির মধ্যেই রয়েছে সুন্দরবন এবং এই ভূমি প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

নবগঠিত ভূমি বা চর এর মধ্যবর্তী বিভিন্ন নদী এবং নালার সৃষ্টি হয়েছে। সুন্দরবন সৃষ্টি হওয়ার পরে মানুষ একপর্যায়ে সুন্দরবনের গাছ কেটে বসতি গড়ে তুলেছে, কোন কোন স্থানে নদী বিলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বৃষ্টির জল জনপদের ভূমি ধৌত করে এইসব বিলে সঞ্চিত হয়। বিলের জল নিষ্কাশনের জন্য বিল ও নদীর মধ্যে সংযোগ খাল খনন করা হয়। এক সময় খালের মাধ্যমে বিলের জল নদী দিয়ে নিষ্কাশিত হয়ে, জনপদকে জলবদ্ধতা থেকে রক্ষা করতো।

পোলডার (Polder)

পোলডার ডেনিস শব্দ। এর অর্থ নিম্নভূমিকে উদ্ধার করা। কোন নির্দিষ্ট এলাকাকে রিং বাঁধের আওতায় এনে, রিং বাঁধের অভ্রান্তরে জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা সুইচ গেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হলে তাকে পোলডার বলে। উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্পের আওতায় নদীর উভয় পাস বরাবর বাঁধ দিয়ে অভ্যন্তরীণ নিষ্কাশন চ্যানেলের উপর সুইস গেট স্থাপন করা হয়। সুইচ গেট এর সিস্টেম হল, সুইচের অভ্যন্তরে নদীর পানি প্রবেশ করতে না দেওয়া। কেবলমাত্র বর্ষার পানি অভ্যান্তরভাগ থেকে সুইচের মাধ্যমে বের করে দেওয়া হয়।

পোলডার পূর্ব অবস্থা (১৯৬০ সালের পূর্ব অবস্থা) (Before Polder system)

জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ১৯৫৭ সালে বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও কারণ অন্বেষণ করে ক্রপ মিশন। ১৯৬৪ সালে ক্রপ মিশন চূড়ান্ত প্রস্তাব পেশ করা হয়, এতে বলা হয় যে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বন্যা ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে মুক্তি করতে হলে পোলডার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। আলোচ্য এলাকার জলনিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম হল ভৈরব ও তার শাখা নদী। ভৈরব একসময় ভয়ংকর নদী ছিল।

কালক্রমে ভৈরব তার নাব্যতা হারিয়ে প্রায় মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। যেস্থানে ভৈরব থেকে কপতাক্ষ নদ উৎপত্তি হয়েছে ওই স্থানে ভৈরব নদীতে ১৭৯৪ সালে চর পড়েছিল। এভাবে ভৈরবের নানা স্থানের চর পড়ে ভরাট হয়ে যশোর, খুলনার মারাত্মক ক্ষতি করেছে। ভদ্রা ও কপোতাক্ষ নদ এক সময় তরঙ্গসংকুল ছিল। হরিহর, বুড়িভদ্রা ও ভদ্রা নদী অবতর শাখা কপোতাক্ষের সাদা শাখা। পোল্ডার ব্যবস্থার পূর্বে এলাকার মোট ভূমির প্রায় ৮০ পার্সেন্ট ভূমি জলাভূমি ছিল। ওই জলাভূমি দিনে দুইবার জোয়ার ভাটার মাধ্যমে পানি দ্বারা পূর্ণ ও শূন্য হতো। নদী বাহিত পলির জলাভূমিতে সঞ্চিত হয়ে ভূমি গঠন করত।

পোলডার পরবর্তী অবস্থা (১৯৬০-১৯৮০) (After polder system)

৬০ এর দশকে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে পোলডার ব্যবস্থা চালু করা হয়। এ লক্ষ্যে ৩৭ টি পোলডার, ১৫৬৬ কিলোমিটার বাঁধ, ২৮২ টি সুইচগেট নির্মাণ করা হয়। পোলডার ব্যবস্থার পূর্বে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভাল ছিল না। তখন মাঝেমধ্যে বন্যা ও লবণাক্ত জল বিলের প্রবেশ করত। ফোল্ডার ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল-
  • বন্যার কবল থেকে মুক্ত করা,
  • মূল ভূখণ্ডে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ ঠেকানো, এবং
  • উচ্চ ফলনশীল চাষ আবাদের প্রচলন ঘটানো।
পোলডার ব্যবস্থা চালু হবার পর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জল নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি হয়। ৬০ এর দশক থেকে ৮০ সাল পর্যন্ত এলাকার জলনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো ছিল। ৮০ সালের পর থেকে জলনিষ্কাশন ব্যবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটে এবং জলবদ্ধতা দেখা দেয়।

৮০ সালের পরবর্তী অবস্থা

৮০ সালের পর থেকে অত্র এলাকায় জলবদ্ধতা শুরু হয়। প্রতিবছর এ জলবদ্ধতা নতুন নতুন এলাকার সম্প্রসারিত করেছে। নদী ও খালে পানি পড়ে ভরাট হয়ে জলনিষ্কাশনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। দলবদ্ধতার অভিশপ্ত জল কেড়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের সুখ-শান্তি। স্থানীয় অধিবাসীদের ও সরকারের প্রচেষ্টায় জলবদ্ধতার তীব্রতা কোন কোন বছর হ্রাস পেলেও, এ সমস্যার স্থায়ী কোন সমাধান হয়নি। তবে জলবদ্ধতার তীব্রতা প্রতি বছর সমান হয় না। এটা নির্ভর করে বৃষ্টিপাত ও ঢল পানির উপর।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জলনিষ্কাশন বা নদী ব্যবস্থার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নদী হল-গঙ্গা-পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, গড়াই, মধুমতি, পশুর ও রুপসা। নিম্নে নদীগুলোর সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল,-

গঙ্গা-পদ্মা নদী

ভারতের হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে গঙ্গা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করার পরই এটি "পদ্মা" নামে পরিচিত। পদ্মা বাংলাদেশের একটি প্রধান নদী যা রাজশাহী, পাবনা, ফরিদপুরসহ অনেক জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়। এর পানি প্রবাহ কৃষি, নৌপরিবহন এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আড়িয়াল খাঁ নদী

আড়িয়াল খাঁ নদী মূলত পদ্মা নদীর একটি শাখা, যা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও আশপাশের এলাকায় প্রবাহিত। বর্ষার সময় এই নদীর পানিপ্রবাহ অনেক বেড়ে যায়, যা কৃষি ও পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নদীটি আঞ্চলিক জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

গড়াই নদী

গড়াই নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে অবস্থিত এবং পদ্মা নদী থেকেই এর উৎপত্তি। এটি কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মধুমতিতে মিলিত হয়েছে। গড়াই নদী একসময় নৌবাণিজ্যে ব্যবহৃত হতো এবং এখনো কৃষিকাজ ও সেচের জন্য মূল্যবান।

মধুমতি নদী

মধুমতি নদী গড়াই নদীর একটি ধারা হিসেবে গড়ে উঠেছে এবং এটি খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর মধ্যে একটি। এই নদীটি নোনা ও মিষ্টি পানির মিলনের এক অনন্য নিদর্শন। এটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও কৃষির জন্য অপরিহার্য।

পশুর নদী

পশুর নদী মূলত খুলনা বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ জলপথ যা মোংলা বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত। সুন্দরবনের পাশ দিয়ে প্রবাহিত এই নদী পরিবহন, মাছ ধরা এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বর্ষাকালে এর রূপ খুবই মনোমুগ্ধকর।

রূপসা নদী

রূপসা নদী খুলনার অদূরে অবস্থিত এবং এটি ভৈরব ও পশুর নদীর মিলিত ধারার ফল। এটি খুলনা শহরের প্রধান নদী হিসেবে পরিচিত এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম, বিশেষত শিল্প ও বাণিজ্যে এর বড় ভূমিকা রয়েছে। রূপসা ব্রিজ এ নদীর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তোলে।

মন্তব্য

আমি আজকের এই প্রতিবেদনে- বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জলনিষ্কাশন সমস্যা ও নদীব্যবস্থা সমূহ নিয়ে আলোচনা করেছি এবং সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি বলে আমি মনে করি। এই কনটেন্টের নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বিভিন্ন লেখকের বই পুস্তক থেকে অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করা হয়েছে। আমি আশা করছি, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জলনিষ্কাশন সমস্যা ও নদীব্যবস্থা সমূহ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা পেয়েছেন। এতক্ষণ থেকে আর্টিকেলটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url