বাংলাদেশের জলবায়ু অঞ্চলের শ্রেণীবিভাগ বা জলবায়ুর সংক্ষিপ্ত বিবরণ
প্রিয় স্টুডেন্ট, তোমরা কি "বাংলাদেশের জলবায়ু অঞ্চলের শ্রেণীবিভাগ বা জলবায়ুর সংক্ষিপ্ত বিবরণ" সম্পর্কে সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য জানতে আগ্রহী। এই বিষয়ে কোথায় সঠিক তথ্য খুঁজে পাবে এই নিয়ে খুব চিন্তিত ? তাহলে এবার সঠিক জায়গায় এসেছ কারণ, আজকের এই প্রতিবেদনে "বাংলাদেশের জলবায়ু অঞ্চলের শ্রেণীবিভাগ বা জলবায়ুর সংক্ষিপ্ত বিবরণ" সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
ভূমিকা
সাধারণত কোন ভৌগোলিক এককের এক বা কয়েক দিনের বায়ুমণ্ডলের নিয়ামক সমূহের ( তাপ, চাপ, বায়ুপ্রবাহ, আদ্রতা, বৃষ্টিপাত ) সার্বিক অবস্থাকে আবহাওয়া বলে। দীর্ঘ প্রায় ২০ থেকে ৩০ বছরের দৈনন্দিন আবহাওয়া পর্যালোচনা করে বায়ুমণ্ডলের ভৌত উপাদানগুলোর যে সাধারণ অবস্থা দেখা যায় তাকে ঐ এককের জলবায়ু বলে।
বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ হলেও মূলত তিনটি ঋতুর প্রলক্ষণ বেশি পরিলক্ষিত হয়। যথা- শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা। এই তিনটি ঋতুর পার্থক্য খুব সহজে এবং পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। বাকি তিনটি ঋতু শরৎ, হেমন্ত ও বসন্তকাল প্রকৃতিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে বোঝা যায় না।
শীতকালঃ বাংলাদেশে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শীতকাল যখন মেঘমুক্ত নীল আকাশ বিরাজ করে। তখন শুষ্ক আবহাওয়া এবং রৌদ্র উজ্জ্বল দিনের আলো থাকে। এই সময়ে দেশের সাধারণত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হয় ৬° সেলসিয়াস থেকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৮° সেলসিয়াস। তবে দেশের অঞ্চলভেদে তাপমাত্রার পার্থক্য হয়ে থাকে।
গ্রীষ্মকালঃ মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল। এই সময়ে উপকূল এলাকা ব্যতীত অন্যত্র তাপমাত্রা ৯৫° ফারেনহাইট এবং দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা ৮৯° ফারেনহাইট এর কাছাকাছি পরিলক্ষিত হয়। এই সময়ে দেশে সূর্য লম্বভাবে কিরণ দেয়। কারণ তখন সূর্য কর্কটক্লান্তি রেখার আশেপাশে অবস্থান করে। গ্রীষ্মকালে মাঝেমধ্যে দেশে কালবৈশাখী ঝড়ের সৃষ্টি হয়। সাধারণত বিকালের দিকে কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয় এবং তা ফসল ও ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে।
বর্ষাকালঃ বাংলাদেশে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বর্ষাকাল। এই সময়ে সারাদেশে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। ১২৮ থেকে ৩৯৮ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এই সময়ে বাতাসের আদ্রতা থাকে ৮০%। দেশের আদ্রতা সর্বত্র সমান নয়। বর্ষাকালে আকাশ মেঘে ঢেকে থাকে। তাপমাত্রা পরিমাণ ২৭° সেলসিয়াস।
বাংলাদেশের জলবায়ুর আঞ্চলিক ধরন
বাংলাদেশ ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ুর অন্তর্গত। তবে ভৌগোলিক অবস্থানজনিত কারণে জলবায়ুর কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। দেশের উত্তরে হিমালয় পর্বত, পূর্বে পাহাড়ি এলাকা এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। এ কারণে বাংলাদেশের জলবায়ুর আঞ্চলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। তবে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জলবায়ু বেশি চরমভাবাপন্ন।
বাংলাদেশের জলবায়ু অঞ্চলের শ্রেণীবিভাগ
বিভিন্ন ভূগোলবিদ ও জলবায়ু বিজ্ঞানী বাংলাদেশের জলবায়ু অঞ্চলকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করেছেন নিম্নে এগুলো উল্লেখ করা হলো-
বিখ্যাত জার্মান ভূগোলবিদ (Dr. Wladimir Koppen) কোপেন ১৯০১ সালে বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর যে শ্রেণীবিভাগ করেছেন সে মোতাবেক বাংলাদেশে তিনটি জলবায়ু অঞ্চল বিরাজমান। তার জলবায়ু শ্রেণীবিভাগের মূল ভিত্তি ছিল তিনটি যেমন- বার্ষিক গড় উষ্ণতা, বৃষ্টিপাত ও স্বাভাবিক উদ্ভিজ্জ। এ সমস্ত বিষয়ের ভিত্তিতে তিনি বাংলাদেশের জলবায়ু অঞ্চলকে তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত করেছেন। এগুলো হলো-
(I) ক্রান্তীয় সাভানা জলবায়ু অঞ্চল
দেশের সমগ্র মধ্যভাগে অর্থাৎ বৃহত্তর ঢাকা, রাজশাহী, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর ও ফরিদপুর জেলা এই জলবায়ু অঞ্চলের আওতাভূক্ত।
(II) মৌসুমী সাভানা জলবায়ু অঞ্চল
দেশের সর্ব উত্তরের জেলা সমূহ অর্থাৎ বৃহত্তর দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট জেলা এই জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত।
(III) ক্রান্তীয় বৃষ্টিযুক্ত জলবায়ু অঞ্চল
দেশের উপকূলীয় জেলা সমূহ অর্থাৎ সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি জেলা এ জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত জলবায়ু বিজ্ঞানী থার্নওয়েট (C. W. Thornthwaite) ১৯৩১ সালে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু শ্রেণীবিভাগ করেন। তিনি বিশ্ব জলবায়ু শ্রেণীবিভাগ এর মূল ভিত্তি হিসেবে প্রতি মাসের বৃষ্টিপাত, বাষ্পীভবন ও প্রসেদনকে ব্যবহার করেন। তার জলবায়ুর শ্রেণীবিভাগের আলোকে বাংলাদেশকে তিনটি জলবায়ু অঞ্চলে বিভক্ত করা যায়। যথা-
(I) উপা-আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চল
বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনা জেলা এবং রাজবাড়ী জেলা এই শ্রেণীর জলবায়ুর অঞ্চলের অন্তর্গত।
(II) আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চল
বৃহত্তর বগুড়া, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, বরিশাল, কুমিল্লা জেলা এবং দিনাজপুর ও সিলেট জেলার আংশিক এই শ্রেণীর আওতাভুক্ত।
(III) প্রাক-আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চল
বৃহত্তর দিনাজপুর ও রংপুর জেলার উত্তরাংশ, সিলেট জেলার পূর্বাংশ এবং সমগ্র চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলা এই শ্রেণীর জলবায়ুর আওতাভুক্ত।
বাংলাদেশের কয়েকজন প্রখ্যাত ভূগোলবিদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের জলবায়ুর শ্রেণীবিন্যাস করেছেন। তারা হলেন অধ্যাপক নাফিস আহমেদ, অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদ, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম। তাদের জলবায়ুর শ্রেণীবিভাজনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জলবায়ুকে সাধারণত ৬ টি অঞ্চলে বিভক্ত করা যায়। যথা-
১। ক্রান্তীয় সামুদ্রিক জলবায়ু অঞ্চল
২। ক্রান্তীয় বৃষ্টিবহুল জলবায়ু অঞ্চল
৩। উপ-ক্রান্তীয় বৃষ্টিবহুল জলবায়ু অঞ্চল
৪। ক্রান্তীয় আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চল
৫। উপ-ক্রান্তীয় আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চল এবং
৬। ক্রান্তীয়-উপ-ক্রান্তীয় শুষ্কপ্রায় জলবায়ু অঞ্চল।
১। ক্রান্তীয় সামুদ্রিক জলবায়ু অঞ্চল
দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জলবায়ু এই প্রকৃতির। সাধারণত সমুদ্রের নিকটবর্তী স্থলভাগের যে অংশে বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রপঞ্জ দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হয় সেই এলাকাকে উপকূলীয় এলাকা বলে। দেশের কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার পশ্চিমাংশ, সমগ্র সুন্দরবন এলাকা, নোয়াখালী, ফেনী ও বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত সকল দ্বীপ এই জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত। এই জলবায়ু অঞ্চলে গ্রীষ্মকালীন গড় তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং শীতকালীন গড় তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সাধারণত বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুলনা উপকূলে ২২৫ সেন্টিমিটার, বরিশাল উপকূলে ২৫০ সেন্টিমিটার, চট্টগ্রাম উপকূলে ২৭৫ সেন্টিমিটার এবং কক্সবাজার উপকূলে ৩৫০ সেন্টিমিটার পরিলক্ষিত হয়।
২। ক্রান্তীয় বৃষ্টিবহুল জলবায়ু অঞ্চল
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের পাহাড়ী এলাকা অর্থাৎ কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার ব্যতীত অবশিষ্ট এলাকা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি জেলা এ জলবায়ু অঞ্চলের আওতাভুক্ত। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় বিধায় এতে প্রচুর পরিমাণ জলীয় বাষ্প থাকে। আর এইভাবে যখন পাহাড়ি এলাকায় আসে তখন পাহাড়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উপরে উঠে মেঘের সৃষ্টি হয় এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। এ জলবায়ু অঞ্চলের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২৫০ থেকে ৩০০ সেন্টিমিটার।
৩। উপ-ক্রান্তীয় বৃষ্টিবহুল জলবায়ু অঞ্চল
বৃহত্তর সিলেট জেলা এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার উত্তর পূর্বাংশ এই জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত। এই জলবায়ু অঞ্চলের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩৫০ থেকে ৪৬০ সেন্টিমিটার। বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত এই অঞ্চলে হয়ে থাকে।
৪। ক্রান্তীয় আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চল
সাধারণত বাংলাদেশের সমগ্র মধ্যভাগ এই জলবায়ুর আওতাভুক্ত। বৃহত্তর খুলনা ও বরিশাল জেলার উত্তরের সামান্য অংশ, বৃহত্তর ফরিদপুর, ঢাকা ও টাঙ্গাইল জেলা সমগ্র অংশ, বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং বৃহত্তর পাবনা ও বগুড়া জেলার পূর্বাংশ এ জলবায় অঞ্চলের অন্তর্গত। এই জলবায়ু অঞ্চলে বার্ষিক গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এ জলবায়ু অঞ্চলে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে ক্রমান্বয়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৫। উপ-ক্রান্তীয় আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চল
বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলার জলবায়ু এই শ্রেণীর অন্তর্গত। এখানকার জলবায়ু বেশ চরমভাবপন্ন। শীতকালে শীত বেশি আবার গ্রীষ্মকালে গরম বেশি। গড় বার্ষিক তাপমাত্রা সর্বোচ্চ .৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ২০০ সেন্টিমিটার। তবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৬। ক্রান্তীয়-উপ-ক্রান্তীয় শুষ্কপ্রায় জলবায়ু অঞ্চল
বৃহত্তর রাজশাহী ও কুষ্টিয়া জেলা এবং যশোর, পাবনা ও বগুড়া জেলার পশ্চিমাংশের জলবায়ু এই শ্রেণির অন্তর্গত। এই জলবায়ু অঞ্চলটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ ও শুষ্ক। এখানকার বার্ষিক গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৫০ সেন্টিমিটার।
মন্তব্য
বাংলাদেশের জলবায়ু অঞ্চলের শ্রেণীবিভাগ বা জলবায়ুর আঞ্চলিক ধরন বা জলবায়ুর সংক্ষিপ্ত বিবরণ সম্পর্কিত বিষয়ে সঠিক এবং নির্বাচিত তথ্য উপস্থাপন করেছি। আশা করছি এই বিষয়ে পরিপূর্ণ ধারণা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এই প্রতিবেদনে সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য উপস্থাপন করার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্বনামধন্য লেখকের বই-পুস্থ এর সহায়তা গ্রহণ করা হয়েছে। আমি আশা করছি উক্ত বিষয় সম্পর্কে সঠিক এবং পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। এতক্ষণ ধরে মনোযোগের সহিত এই প্রতিবেদনটি পড়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
Hasi Online IT নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url